
সূচিপত্র (Table of Contents)
সিকান্দর কি সত্যিই মহান ছিলেন? এক ঐতিহাসিক পর্যালোচন
সিকান্দরের নাম উঠলেই একজন মহান যোদ্ধা ও ন্যায়পরায়ণ রাজার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাঠ্যপুস্তকে তাকে ‘সিকান্দর মহান’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাকে যে মহান বলা হয়, তা একজন নৃশংস ও কাপুরুষ আক্রমণকারীর প্রতি অযাচিত সম্মান প্রদর্শন। এই ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে। সিকান্দর, যিনি ম্যাসেডোনিয়ার গ্রিক শাসক ছিলেন, গ্রিসে তার প্রভাব ছিল প্রবল। পশ্চিমা ইতিহাসবিদরা গ্রিসের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস লিখে তাকে বিশ্বজয়ী ও মহান যোদ্ধা হিসেবে প্রচার করেছেন। কিন্তু যেসব দেশে সিকন্দর আক্রমণ করেছিল, সেখানকার ইতিহাস তার এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। সত্য হলো, সিকান্দর মহান ছিলেন না; বরং তিনি বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস আক্রমণকারী ও হত্যাকারীদের একজন। তার জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা তাকে মহান বা ন্যায়পরায়ণ রাজা বলার পক্ষে সমর্থন করে না। ভারতের দুর্ভাগ্য বা ভারতীয়দের অজ্ঞতার কারণে আমরা তাকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মহান শাসক হিসেবে উপস্থাপন করেছি।
একটি সভ্যতা, যার ইতিহাসে কেবল দাসপ্রথার কথা রয়েছে, তারা সিকান্দরকে মহান বললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সর্বগুণে সমৃদ্ধ ভারতীয় সভ্যতা যদি সিকান্দরকে মহান বলে, তবে তা নিশ্চিতভাবে উদ্বেগের বিষয়। তাই সিকান্দর সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা অত্যন্ত জরুরি, যা আমাদের ভারতীয়দের ইতিহাসে শেখানো হয় না। আসুন, এই সত্য যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি।
সিকান্দরের জীবন ও কর্ম: এক নৃশংস যাত্রা
সিকান্দর তার পিতার মৃত্যুর পর নিজের সৎভাই ও চাচাতো ভাইদের হত্যা করে ম্যাসেডোনিয়ার সিংহাসনে বসেন। তার অতি উচ্চাভিলাষের কারণে তিনি বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেন। আশপাশের বিদ্রোহীদের দমন করে তিনি ইরান আক্রমণ করেন। ইরান জয়ের পর গর্ডিয়াস জয় করেন, তারপর টায়ারকে ধ্বংস করেন। ব্যাবিলন জয় করে পুরো রাজ্যে আগুন লাগিয়ে দেন। এরপর আফগানিস্তানের অঞ্চল ধ্বংস করে সিন্ধু নদী পর্যন্ত পৌঁছে যান।
প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা
পশ্চিমা শিক্ষায় প্রচার করা হয় যে সিকান্দর বিশ্বজয়ী ছিলেন এবং ভারত আক্রমণের সময় রাজা পুরুকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু সত্য হলো, সিকান্দর তার বিজয়ের গর্বে অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের অবতার মনে করতেন এবং পূজার যোগ্য বলে বিবেচনা করতেন। কিন্তু ভারতে এসে তার এই অহংকার চূর্ণ হয়, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতে সিকান্দরের যুদ্ধ: অহংকার চূর্ণের অধ্যায়
সিন্ধু নদী পার হওয়ার পর ভারতে তিনটি ছোট ছোট রাজ্য ছিল: তক্ষশিলা (রাজা আম্ভী), পুরু (পোরাস), এবং আম্ভিসার (কাশ্মীরের চারপাশে বিস্তৃত)। আম্ভী পুরুর সঙ্গে পুরনো শত্রুতার কারণে সিকান্দরের সঙ্গে হাত মেলায়। আম্ভিসারও নিরপেক্ষ থেকে সিকান্দরের পথ ছেড়ে দেয়। কিন্তু ভারতমাতার বীরপুত্র পুরু সিকান্দরের সঙ্গে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের বিবরণ: মহানতার আড়ালে থাকা সত্য
প্লুতার্কের বিবরণ: সিকান্দর আম্ভীর সাহায্যে সিন্ধু নদীর উপর একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণ করেন। তার সেনায় ২০,০০০ পদাতিক ও ১৫,০০০ অশ্বারোহী ছিল, যা পুরুর সেনার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। আম্ভীর সেনাও সিকান্দরকে সাহায্য করেছিল।
কার্তিয়াসের বিবরণ: সিকান্দর ঝিলম নদীর ওপারে শিবির স্থাপন করেছিলেন। তার সেনার একটি অংশ ঝিলমের একটি দ্বীপে পৌঁছে যায়। পুরুর সৈন্যরাও সাঁতরে সেই দ্বীপে পৌঁছে গ্রিক সেনাদের আক্রমণ করে। অনেক গ্রিক সৈন্য নিহত হয়, এবং বাকিরা নদীতে ডুবে যায়। সিকন্দর বাকি সেনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে নৌকায় হরনপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার উজানে গিয়ে নদী পার করেন। সেখানে ভয়ানক যুদ্ধ হয়, যেখানে পুরুর বড় ছেলে বীরগতি প্রাপ্ত হন।
এরিয়ানের বিবরণ: ভারতীয় যুবরাজ (পুরুর ছেলে) একাই সিকান্দরের ঘেরাওয়ের মধ্যে ঢুকে তাকে আহত করে এবং তার ঘোড়া ‘বুসেফালাস’-কে হত্যা করে। বলা হয়, পুরুর হাতিরা দলদলে আটকে যাওয়ায় সিকন্দর পুরুর ছেলেকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
কার্তিয়াস আরও লেখেন: হাতিরা ভয়ানক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তাদের গর্জনের কারণে সিকান্দরের ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। সিকান্দরের সেনারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকে। হাতিরা সিকান্দরের সেনাদের পায়ের তলায় পিষে ফেলতে শুরু করে। একটি হাতি গ্রিক সৈন্যদের শুঁড়ে ধরে মাহুতের হাতে তুলে দিত, এবং মাহুত তাদের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিত। এভাবে দিনভর যুদ্ধ চলতে থাকে।
দিওদোরাসের বিবরণ: হাতিদের অপার শক্তি ছিল, এবং তারা অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়। তারা অসংখ্য গ্রিক সৈন্যকে পায়ের তলায় চূর্ণ করে দেয়।
বলা হয়, পুরু অপ্রয়োজনীয় রক্তপাত বন্ধ করতে সিকান্দরকে একা লড়াইয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভীত সিকান্দর সেই বীরত্বপূর্ণ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ইথিওপিয়ান মহাকাব্যের সম্পাদক ই.এ.ডব্লিউ. বাজ লেখেন, ঝিলমের যুদ্ধে সিকান্দরের অশ্বারোহী সেনার বেশিরভাগই নিহত হয়। সিকান্দর বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তিনি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবেন। তাই তিনি পুরুর কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ করেন। রাজা পুরু সম্মত হন এবং সিকান্দরের সঙ্গে সন্ধি করেন। ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে, পুরু শত্রুকে হত্যা করেননি। সন্ধির শর্ত ছিল, পুরু সিকান্দরকে জীবনদান করবেন, এবং বিনিময়ে সিকান্দর প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি আর কখনো ভারতে আক্রমণ করবেন না।
সিকান্দরের পরাজয়, প্রত্যাবর্তন ও মৃত্যু
অহংকার চূর্ণ ও সৈন্যদের বিদ্রোহ
প্রাচীন ভারতের প্রতিরক্ষামূলক দেয়ালের সঙ্গে সংঘর্ষে সিকান্দরের অহংকার চূর্ণ হয়ে যায়। তার সৈন্যরা ভয়ে বিদ্রোহ করে। সিকান্দর পুরুর কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চান। পুরু তাকে যে পথে এসেছিলেন, সেই পথে ফিরতে নিষেধ করেন এবং দক্ষিণের পথে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। ফেরার পথে সিকান্দরের সৈন্যরা ক্ষুধার জন্য পথচারীদের লুট করতে শুরু করে। এই লুটপাটকে ভারতীয় ইতিহাসে সিকান্দরের দক্ষিণের বিজয় হিসেবে লেখা হয়। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের পথে মালবী নামক একটি ছোট ভারতীয় গণরাজ্য সিকান্দরের লুটপাটের বিরোধিতা করে। এই যুদ্ধে সিকান্দর গুরুতরভাবে আহত হন।
প্লুতার্ক লেখেন: “ভারতের সবচেয়ে ভয়ানক যোদ্ধা মালবী জাতির হাতে সিকান্দর প্রায় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের তরোয়াল ও বর্শা সিকান্দরের বর্ম ভেদ করে তাকে গুরুতরভাবে আহত করে। শত্রুর একটি তীর তার বর্ম ভেদ করে পাঁজরে বিঁধে যায়। সিকান্দর হাঁটু গেড়ে পড়ে যান। শত্রু তার মাথা কেটে ফেলতে যাচ্ছিল, তখন পিউসেস্তাস ও লিমনিয়াস এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাদের একজন নিহত এবং অপরজন গুরুতর আহত হয়। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সিকান্দরের গলায় একটি লোহার লাঠির আঘাত লাগে, এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তার দেহরক্ষীরা তাকে সেই অবস্থায় বের করে নিয়ে যায়।”
ভারতের এই সংগ্রামই সিকান্দরের মৃত্যুর কারণ হয়। ফেরার পথে তিনি ব্যাবিলনে থামেন। ভারত জয়ের অহংকার চূর্ণ হওয়ায় তিনি অতিরিক্ত মদ্যপান শুরু করেন। তীরের ক্ষত ছড়িয়ে পড়ে, এবং তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। কিছুদিন পর সেই জ্বরই তার প্রাণ কেড়ে নেয়।
সিকান্দরের মৃত্যু: বিষ প্রয়োগের সম্ভাবনা
এটাও বলা হয়, পুরুর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর গ্রিক সৈন্যরা নন্দ সাম্রাজ্যের ২.৫ লক্ষ সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে। তারা বলে, পুরুর ১৫,০০০ সৈন্য এই অবস্থা করেছে, তাহলে নন্দের সেনা তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। সৈন্যদের বিরোধিতার পর সিকন্দরও অস্ত্র ত্যাগ করেন। কিন্তু ব্যাবিলনে ফিরে তিনি নন্দের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। এটি তার সেনা ও সঙ্ঘের পছন্দ হয়নি। তারা ভারতের মতো শক্তিশালী জাতির সঙ্গে শত্রুতা করে সবকিছু হারাতে চায়নি। ফারস থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ গ্রিসে পাঠানোর পরিবর্তে যুদ্ধে ব্যয় হতো, যা সঙ্ঘ ও সৈন্যরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে, ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে সিকান্দরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়, এবং তার একমাত্র পুত্র এলেকজান্ডার চতুর্থকেও হত্যা করা হয়।
ঐতিহাসিক সত্য: সিকান্দরের পরাজয় ও ভারতের প্রতিরোধ
সিকান্দরের পরাজয়
স্পষ্টতই বোঝা যায়, সিকান্দর ভারতের একটিও রাজ্য জয় করতে পারেননি। পুরুর কাছে প্রচণ্ড পরাজয়ের পরও ইতিহাসে লেখা হয়েছে যে সিকান্দর পুরুকে পরাজিত করেছিলেন। ভারতে মহান রাজা পুরুর বিজয়কেও তার পরাজয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়। গ্রিস সিকান্দরকে মহান বলতে পারে, কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসে মহান হিসেবে লেখা উচিত পুরুকে, যিনি একজন বিদেশি আক্রমণকারীর অহংকার চূর্ণ করেছিলেন।
সিকান্দরের নৃশংসতা ও ভারতের প্রতিরোধ
সিকান্দরকে প্রথমে একটি গণরাজ্যের প্রধানের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়, যাকে গ্রিকরা ‘এস্টিজ’ বলে, সংস্কৃতে যার নাম হস্তিন। তিনি হাস্তিনায়ন জাতির প্রধান ছিলেন। তিনি পুষ্কলাবতী নামক রাজধানীতে গ্রিকদের ঘেরাওয়ের ৩০ দিন ধরে মোকাবিলা করেন এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নিহত হন। আশ্বায়ন ও আশ্বকায়নরাও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করেন। তাদের ৪০,০০০ সৈন্য বন্দি হয় এবং ২,৩০,০০০ বলদ সিকান্দরের হাতে আসে।
আশ্বকায়নরা ৩০,০০০ অশ্বারোহী, ৩৮,০০০ পদাতিক ও ৩০টি হাতির সেনা নিয়ে সিকান্দরের মোকাবিলা করে। তাদের রানি ক্লিওফিস (সংস্কৃত: কৃপা?) নেতৃত্বে নারীরাও প্রতিরক্ষায় অংশ নেন। বেতনভোগী সৈন্যরা প্রথমে নিরুৎসাহে লড়লেও পরে উৎসাহিত হয়ে ‘অপমানের জীবনের চেয়ে গৌরবের মৃত্যু’ বেছে নেন। এই উৎসাহ আশপাশের অভিসার রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
সিকান্দরের আক্রমণের সময় আচার্য চাণক্য (বিষ্ণুগুপ্ত বা কৌটিল্য) তক্ষশিলায় প্রাধ্যাপক ছিলেন। তিনি চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং সিকান্দরের নিযুক্ত পাঞ্জাবের রাজদূত সেলুকাসকে পরাজিত করেন। সিন্ধু নদীর নিম্নাঞ্চলে শিবিগণের পাশে অগলাস্সোই নামক গণরাজ্য ছিল। তারা ৪০,০০০ পদাতিক ও ৩,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে সিকান্দরের সঙ্গে লড়াই করে। তাদের একটি নগরের ২০,০০০ বাসিন্দা বন্দি হওয়ার পরিবর্তে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে।
মালব ও ক্ষুদ্রক জাতির সংযুক্ত সেনায় ৯০,০০০ পদাতিক, ১০,০০০ অশ্বারোহী ও ৯০০ রথ ছিল। তাদের ব্রাহ্মণরা পড়াশোনা ছেড়ে তরোয়াল হাতে যুদ্ধে নামেন এবং প্রাণ বিসর্জন দেন। কঠ জাতি তাদের বীরত্বের জন্য বিখ্যাত ছিল; তাদের ১৭,০০০ সৈন্য নিহত ও ৭০,০০০ বন্দি হয়। মালবরা ৫০,০০০ সৈন্য নিয়ে একটি নদী উপত্যকা রক্ষা করে। অম্বষ্ঠদের সেনায় ৬০,০০০ পদাতিক, ৬,০০০ অশ্বারোহী ও ৫০০ রথ ছিল। সিন্ধু উপত্যকায় ৮০,০০০ সৈন্য নিহত হয়। ব্রাহ্মণরা প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন এবং ধর্মরক্ষার জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দেন।
অন্যান্য দেশে সিকান্দরের নৃশংসতা
প্রাচীন ইরানের আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সেপোলিসের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া পর্যটকদের তিনটি কথা বলা হয়: এটি দারিয়ুস মহান নির্মাণ করেছিলেন, তার পুত্র জেরক্সেস এটি সম্প্রসারিত করেছিলেন, এবং সিকান্দর এটি ধ্বংস করেছিলেন।
পশ্চিমা ইতিহাসের বই পড়লে মনে হয় ইরানিরা যেন সিকান্দরের জয়ের জন্যই সৃষ্ট। ইরানিরা আগে দুবার গ্রিকদের কাছে পরাজিত হয়েছিল, তাই সিকান্দর প্রতিশোধ নিতে ইরান আক্রমণ করেন। কিন্তু ইরানি দৃষ্টিকোণ থেকে সিকান্দর মহানতা থেকে অনেক দূরে ছিলেন। তিনি এক গ্রিক নৃত্যশিল্পীর প্রভাবে মদ্যপান করে পার্সেপোলিস ধ্বংস করেন, দাবি করে যে এটি গ্রিসের অ্যাক্রোপলিস পোড়ানোর প্রতিশোধ। তিনি ইরানের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্থানগুলোতে ক্ষতি করেন এবং পারসিক ধর্মের উপাসনাস্থলগুলোতে আক্রমণ করেন।
পশ্চিমা দেশগুলো গ্রিক ভাষা ও সংস্কৃতির সাহায্যে সিকান্দরের আক্রমণকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে, এটি পূর্বের বর্বর সমাজকে সভ্য করার প্রথম পশ্চিমা অভিযান ছিল। তাদের মতে, আমরা সবাই অসভ্য ছিলাম, এবং সিকান্দর হত্যার মাধ্যমে আমাদের সভ্য করতে চেয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদ এরিয়ান লেখেন: ব্যাক্ট্রিয়ার রাজা বেসাসকে বন্দি করার পর সিকন্দর তাকে বেত্রাঘাত করেন, তার নাক-কান কেটে ফেলেন এবং শেষে হত্যা করেন। তিনি তার প্রিয় দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ভাগ্নে ক্যালাস্থেনিসকে হত্যায় দ্বিধা করেননি। একটি তুচ্ছ বিষয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্লাইটাসকে হত্যা করেন। তার পিতার বন্ধু পারমেনিয়ন, যার কোলে সিকান্দর খেলেছিলেন, তাকেও হত্যা করেন। তার সেনা যেখানেই যেত, সম্পূর্ণ নগর পুড়িয়ে দেওয়া হতো, সুন্দরী নারীদের অপহরণ করা হতো।
উপসংহার: সিকান্দরের মহানতার কোনো প্রমাণ নেই
ইতিহাসে সিকান্দরের মহানতার কোনো ঘটনা বা তার দেশের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচারের প্রমাণ নেই। তার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল হত্যাকাণ্ড ও লুটপাটই দেখা যায়। সিকান্দরের উপর অনেক বই লেখা হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেখানে তাকে অত্যন্ত সাহসী ও যুদ্ধকুশল রাজা হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু সত্য হলো, তিনি যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, তারা দুর্বল ছিল বলে পরাজিত হয়েছিল। সিকান্দর যে সঙ্ঘের শক্তিতে কিছু জমি জয় করেছিলেন, তা তার পিতা ফিলিপ গ্রিসের বিভিন্ন রাজ্যকে পরাজিত করে গঠন করেছিলেন। তিনি ফারসকে টানা তিনটি যুদ্ধে পরাজিত করেন, কারণ ফারসের রাজা দারিয়ুস দুর্বল শাসক ছিলেন। তার সাম্রাজ্যের বড় অংশে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরবর্তী যুদ্ধে সিকান্দর ফারসের সেনাদের দাস বানিয়ে নিজের সেনায় যুক্ত করেন, এভাবে তার সেনা বড় হতে থাকে। তিনি যুদ্ধ জিততে থাকেন, হত্যা করতে থাকেন, শহরের পর শহর পুড়িয়ে দেন, ধন-সম্পদ লুট করে নিজের দেশে পাঠান। কিন্তু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে তার বীরত্বের মিথ্যা ধারণা ভেঙে যায়। শেষে তিনি তার সেনা নিয়ে নৌকায় নদীর পথে পালিয়ে যান।
যে রাজা কেবল সাম্রাজ্য জয়ের পেছনে ছুটেন, জনগণ, দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে পদদলিত করেন, তিনি কীভাবে মহান হতে পারেন? সিকান্দরের মতো ব্যক্তিরা সভ্যতার শান্ত প্রবাহে মহামারীর মতো ছিলেন। তারা আগ্নেয়গিরির মতো হৈচৈ সৃষ্টি করে সভ্যতার শান্ত প্রবাহে ধ্বংসলীলা চালিয়ে শূন্যে বিলীন হয়ে যান। যেখানেই গিয়েছেন, সেখানকার মানুষকে দাস বানিয়েছেন, স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রতি নৃশংস প্রতিশোধ নিয়েছেন। সিকান্দরের মতো ব্যক্তিদের ইতিহাসে ‘মহান’ বলা অত্যন্ত লজ্জাজনক।