সূচিপত্র (Table of Contents)
সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মের শাস্ত্রে মহিলাদের বেদ অধ্যয়নের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এই অসংখ্য প্রমাণ উপেক্ষা করে কিছু অজ্ঞ ব্যক্তি "গুটিকয়েক প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের" ভিত্তিতে মহিলাদের অধিকারহীন প্রমাণ করার মূর্খতাপূর্ণ প্রয়াস করে। এরা বিদ্যার জন্য বিদ্যার দেবী সরস্বতী, যিনি নারী দেহধারিণী, তাঁর উপাসনা করেন, অথচ মহিলাদের বেদপাঠ থেকে বঞ্চিত করার কথা বলেন। অর্থাৎ, প্রথমে বিদ্যার জন্য নারী সরস্বতীর শরণাপন্ন হন, এবং বিদ্যা লাভের পর এই "ফতোয়া" জারি করেন যে মহিলাদের অধিকার নেই—এটা হাস্যকর।
এই মূঢ়রা কখনো ভাবেন না যে, যদি মহিলাদের বেদমন্ত্রের অধিকার না থাকে, তাহলে প্রাচীনকালে মহিলারা কেন বেদের মন্ত্রদ্রষ্ট্রী-ঋষিকা হয়েছিলেন? যদি তাঁরা বেদের অধিকারিণী না হন, তাহলে যজ্ঞ ইত্যাদি ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে এবং ষোড়শ সংস্কারে তাঁদের কেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়? বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে মহিলাদের মুখে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করানো হয় কেন? বেদমন্ত্র ছাড়া মহিলারা কীভাবে নিত্য সন্ধ্যা ও হোম করতে পারেন? যদি মহিলারা অধিকারহীন হতেন, তাহলে অনসূয়া, অহল্যা, অরুন্ধতী, মদালসা প্রভৃতি অগণিত মহিলারা বেদশাস্ত্রে পারঙ্গম হলেন কীভাবে? জ্ঞান, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাভাবিক অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা কি অন্যায় ও পক্ষপাত নয়? যখন নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী, তখন একাংশ অধিকারী এবং অপরাংশ অধিকারহীন কীভাবে হতে পারে?
যাই হোক, এই প্রশ্নের উত্তর এরা দিতে পারবে না। তবে এখন শাস্ত্র থেকেই তাদের এই অসত্য মতের খণ্ডন করা হল, এবং এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা হল যে—
শাস্ত্র থেকে বিস্তারিত প্রমাণ
ঋগ্বেদ: মন্ত্রদ্রষ্ট্রী ঋষিকাগণ
ঋগ্বেদ ১০.৮৫-এ সম্পূর্ণ মন্ত্রের ঋষিকা হলেন ‘সূর্যা-সাবিত্রী’। নিরুক্তে ঋষির অর্থ এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে— “ঋষির্দর্শনাৎ। স্তোমান্ দদর্শেতি (২.১১)। ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারঃ (২.১১ দু. বৃ.)।” অর্থাৎ, মন্ত্রের দ্রষ্টা, তাদের গূঢ় রহস্য বুঝে প্রচারকারী ঋষি হন।
বৃহদ্দেবতা অনুসারে ঋগ্বেদের ঋষিকাদের তালিকা
- ঘোষা
- গোধা
- বিশ্ববারা
- অপালা
- উপনিষদ, নিষদ
- ব্রহ্মজায়া (জুহূ)
- অগস্ত্যের ভগিনী
- অদিতি
- ইন্দ্রাণী ও ইন্দ্রের মাতা
- সরমা
- রোমশা
- উর্বশী
- লোপামুদ্রা
- নদীগণ
- যমী
- শশ্বতী
- শ্রী, লাক্ষা
- সর্পরাজ্ঞী
- বাক, শ্রদ্ধা, মেধা, দক্ষিণা, রাত্রি
- সূর্যা-সাবিত্রী
—এঁরা সকলেই ব্রহ্মবাদিনী। ঋগ্বেদের ১০-১৩৪, ১০-৩৯, ৪০, ১০-৯১, ১০-৯৫, ১০-১০৭, ১০-১০৯, ১০-১৫৪, ১০-১৫৯, ১০-১৮৯, ৫-২৮, ৮-৯১ ইত্যাদি সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্ট্রী এই ঋষিকারাই।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ও হারীত ধর্মসূত্র
এই মন্ত্রে বলা হয়েছে যে কীভাবে সোম সীতা-সাবিত্রীকে তিন বেদ দিয়েছিলেন।
ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যোবধূ—এই দুই প্রকারের নারী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ব্রহ্মবাদিনীরা যজ্ঞোপবীত, অগ্নিহোত্র, বেদ অধ্যয়ন এবং নিজ গৃহে ভিক্ষাচরণ করেন। সদ্যোবধূদেরও যজ্ঞোপবীত প্রয়োজন, যা বিবাহকালে সম্পন্ন করা হয়।
শতপথ ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ
শতপথ ব্রাহ্মণে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির ধর্মপত্নী মৈত্রেয়ীকে ব্রহ্মবাদিনী বলা হয়েছে—
অর্থাৎ, মৈত্রেয়ী ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মবাদিনীর অর্থ করেছেন ‘ব্রহ্মবাদনশীল’।
বিভিন্ন শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্র থেকে প্রমাণ
- শতপথ ব্রাহ্মণ (১৪.১.৪.১৬): যজুর্বেদের ৩৭.২০ মন্ত্র ‘ত্বষ্টমন্তস্ত্বা সপেম’ এই মন্ত্রটি পত্নীর দ্বারা উচ্চারণের বিধান রয়েছে।
- তৈত্তিরীয় সংহিতা (১.১.১০): ‘সুপ্রজসস্ত্বা বয়ং’ ইত্যাদি মন্ত্রগুলো নারী দ্বারা উচ্চারণের নির্দেশ রয়েছে।
- আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র (১.১.৯): ‘পাণিগ্রহণাদি গৃহ্য....’-তে যজমানের অনুপস্থিতিতে তার পত্নী, পুত্র বা কন্যার যজ্ঞ করার নির্দেশ রয়েছে।
- কাঠক গৃহ্যসূত্র (৩.১.৩০ ও ২৭.৩): নারীদের বেদ অধ্যয়ন, মন্ত্রোচ্চারণ ও বৈদিক কর্মকাণ্ডের বিধান রয়েছে।
- ঐতরেয় (৫.৫.২৯): কুমারী গন্ধর্ব গৃহীতার উপাখ্যানে কন্যার যজ্ঞ ও বেদাধিকারের স্পষ্টীকরণ রয়েছে।
- কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র (১.১.৭, ৪.১.২২, ২০.৬.১২): স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে অমুক বেদমন্ত্র নারী উচ্চারণ করবেন।
- লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র: পত্নী দ্বারা সস্বর সামবেদের মন্ত্র গানের বিধান রয়েছে।
যজুর্বেদের সাক্ষ্য
অর্থ: হে নারী! তুমি কুলবতী, ঘৃত ইত্যাদি পুষ্টিকর পদার্থের সঠিক ব্যবহারকারিণী, তেজস্বিনী, বুদ্ধিমতী, সৎকর্মশীলা হয়ে সুখে বাস করো। তুমি এমন গুণবতী ও বিদুষী হও যে রুদ্র ও বসুগণও তোমার প্রশংসা করেন। সৌভাগ্য লাভের জন্য এই বেদমন্ত্রের অমৃত বারবার পান করো। বিদ্বানরা তোমাকে শিক্ষা দিয়ে উচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করুন।
যজ্ঞে নারীর অপরিহার্যতা
এটা সর্বজনবিদিত যে বেদমন্ত্র ছাড়া যজ্ঞ হয় না এবং যজ্ঞে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপস্থিতি অপরিহার্য। রামচন্দ্রজী সীতার অনুপস্থিতিতে সোনার প্রতিমা রেখে যজ্ঞ করেছিলেন। ব্রহ্মাজীকেও সাবিত্রীর অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করতে হয়েছিল, কারণ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে পত্নীর উপস্থিতি প্রয়োজন। যখন নারী যজ্ঞ করেন, তখন তাঁর বেদাধিকার না থাকার কথা কীভাবে বলা যায়?
ইতিহাস গ্রন্থ থেকে প্রমাণ
মহাভারত
ভারদ্বাজের কন্যা শ্রুতাবতী: "ভারদ্বাজস্য দুহিতা রূপেণাপ্রতিমা ভুবি। শ্রুতাবতী নাম বিভো কুমারী ব্রহ্মচারিণী॥" (মহাভারত শল্য পর্ব ৪৮.২) – অর্থাৎ, ভারদ্বাজের শ্রুতাবতী নামক কন্যা ছিলেন, যিনি ব্রহ্মচারিণী (বেদ অধ্যয়নকারিণী) ছিলেন।
সিদ্ধা নাম্নী তপস্বিনী: "অত্রৈব ব্রাহ্মণী সিদ্ধা কৌমার-ব্রহ্মচারিণী। যোগযুক্তা দিবং যাতা, তপঃ সিদ্ধা তপস্বিনী॥" (মহাভারত শল্য পর্ব ৫৪.৬) – অর্থাৎ, যোগসিদ্ধি লাভকারিণী, কুমার অবস্থা থেকে বেদ অধ্যয়নকারিণী, তপস্বিনী সিদ্ধা নামক ব্রহ্মচারিণী মুক্তি লাভ করেছিলেন।
ব্রহ্মবাদিনী সুলভা: মহাভারত শান্তি পর্ব অধ্যায় ৩২০-এ ‘সুলভা’ নামক ব্রহ্মবাদিনী সন্ন্যাসিনীর বিবরণ রয়েছে, যিনি রাজা জনকের সঙ্গে শাস্ত্রার্থ করেছিলেন।
বাল্মীকি রামায়ণ
- সীতা: "দেহী শোকসন্তপ্তা হুতাশনমুপাগমৎ।" (সুন্দরকাণ্ড ৫৩.২৬) – অর্থাৎ, শোকসন্তপ্তা সীতা হোম করেছিলেন।
- কৈকেয়ী: "তদা সুমন্ত্রং মন্ত্রজ্ঞা কৈকেয়ী প্রত্যুবাচ হ।" (অযোধ্যা ১৪.৬১) – অর্থাৎ, বেদমন্ত্র জানা কৈকেয়ী সুমন্ত্রকে বললেন।
- কৌশল্যা: "সা ক্ষৌমবসনা হৃষ্টা নিত্যং ব্রতপরায়ণা। অগ্নিং জুহোতি স্ম তদা মন্ত্রবৎ কৃতমঙ্গলা॥" (২.২০.১৫) – অর্থাৎ, মঙ্গলকারিণী কৌশল্যা মন্ত্রসহ অগ্নিহোত্র করছিলেন।
- তারা: "ততঃ স্বস্ত্যয়নং কৃত্বা মন্ত্রবিদ্ বিজয়ৈষিণী। অন্তঃপুরং সহস্ত্রীভিঃ প্রবিষ্টি শোকমোহিতা॥" (৪.১৬.১২) – অর্থাৎ, মন্ত্রজ্ঞা তারা তার পতি বালির বিজয়ের জন্য স্বস্তিবাচনের মন্ত্র পাঠ করেছিলেন।
ব্যাকরণ শাস্ত্রের প্রমাণ
ব্যাকরণ শাস্ত্রের কিছু উল্লেখ প্রমাণ করে যে বেদের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নারীদেরও কার্যক্ষেত্র ছিল:
উপাধ্যায়ী বা উপাধ্যায়া: ‘ইডশ্চ’ ৩.৩.২১-এর মহাভাষ্যে লেখা আছে— “উপেত্যাধীয়তেঽস্যা উপাধ্যায়ী উপাধ্যায়া”। অর্থাৎ, যাঁর কাছে এসে কন্যারা বেদের একাংশ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করেন, তিনি উপাধ্যায়ী বা উপাধ্যায়া।
আচার্যা: অষ্টাধ্যায়ীর ‘আচার্যাদণত্বম্।’ (৪.১.৪৯) সূত্রে সিদ্ধান্ত কৌমুদীতে বলা হয়েছে— “আচার্যস্য স্ত্রী আচার্যানী পুংযোগ ইত্যেবং আচার্যা স্বয়ং ব্যাখ্যাত্রী।” অর্থাৎ, যিনি বেদের প্রবচনকারিণী, তিনি আচার্যা।
এমন আরও অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে, যা স্পষ্ট করে যে শাস্ত্রানুসারে নারীদেরও বেদ অধ্যয়নের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।