সূচিপত্র (Table of Contents)
প্রতি বছরের মতো এবারও দশেরার উৎসব এসে গেছে। সবাই বিশেষ করে রাবণের পুতুল দহনের জন্য অপেক্ষা করছে। সকলে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র জী মহারাজকে স্মরণ করেন, যিনি রাক্ষস রাবণকে বধ করে পৃথিবীকে পাপী থেকে মুক্ত করেছিলেন। তাঁর সেই পবিত্র তপস্যার স্মৃতিতে আজ রাবণের পুতুল দহন করা হয়। যাতে জনমানস প্রেরণা পায় যে কীভাবে মন্দের উপর ভালোর জয় হয়।
একটি প্রশ্ন আমার মনে সবসময় আসে, আমাদের আজকের সমাজে কি রাবণ আবার জীবিত হয়ে উঠেছে? উত্তর হলো হ্যাঁ। রাবণ শুধু জীবিত হয়ে ওঠেনি, বরং আগের চেয়েও আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সেই রাবণ কে এবং কোথায় থাকে?
উত্তর হলো, সেই রাবণ হল আমাদের অভ্যন্তরীণ মন্দতা, যা আমাদের মধ্যেই রয়েছে এবং আমাদের প্রতিদিন ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত করে। তার দশটি মাথা রয়েছে, যার উপর যম-নিয়ম রূপী দশটি তলোয়ার দিয়ে জয়লাভ করা যায়।
অভ্যন্তরীণ রাবণের সঙ্গে লড়াই করার দশটি তলোয়ার
এই অভ্যন্তরীণ রাবণের সঙ্গে লড়াই করার দশটি তলোয়ার হলো— যম এবং নিয়ম। যম-নিয়মের পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ মন্দতাগুলো, যা রাবণের দশ মাথার সমান, তার মোকাবিলা করতে পারি।
যম (৫টি)
- অহিংসা
- সত্য
- অস্তেয়
- ব্রহ্মচর্য
- অপরিগ্রহ
নিয়ম (৫টি)
- শৌচ
- সন্তোষ
- তপ
- স্বাধ্যায়
- ঈশ্বর প্রণিধান
১. অহিংসা
সর্বদা সকল প্রাণীর প্রতি শত্রুতা ত্যাগ করে প্রীতির সঙ্গে আচরণ করা অহিংসা। সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষের সঙ্গে পশুপ্রাণীও অন্তর্ভুক্ত। যেখানে জিহ্বার স্বাদ বা পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য নিরীহ প্রাণী হত্যা করা নিশ্চিতভাবে হিংসা। এমনকি চিন্তায় কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার ইচ্ছা করাও হিংসা। যদি কোনো ব্যক্তি চুরি ইত্যাদি করার জন্য তার সংশোধনের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়, তবে তা অহিংসা বলে গণ্য হয়, হিংসা নয়, কারণ সেই কাজটি প্রাণীমাত্রের উদ্ধারের জন্য করা হচ্ছে। একইভাবে, কোনো মানুষখেকো জন্তুকে মারাও হিংসা নয়, কারণ তা জনকল্যাণের জন্য। আজ ধর্মের নামে বিশ্বজুড়ে দাঙ্গা, লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি শোনা যায়। প্রত্যেকে নিজের ধর্ম, মত, চিন্তাধারা, গুরুকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে নীচ মনে করছে। এর ফলে চারদিকে অসুরক্ষা, অবিশ্বাস এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যদি মানুষ অহিংসার এই পাঠ বুঝে নেয় এবং সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ আচরণ করে, তবে হিংসারূপী এই রাবণের ধ্বংস করা যায়।
২. সত্য
যা দেখা গেছে, অনুমানের মাধ্যমে জানা গেছে বা শোনা গেছে, তা মন ও বাক্যে ঠিক তেমনই থাকা সত্য। অর্থাৎ বাস্তব যেমন, তাকে তেমনই জানা, মানা, বলা এবং শরীর দিয়ে তা আচরণে আনা সত্য। সত্যকে পরীক্ষা করে জানা এবং সকলের হিতের জন্য তা বলা ও আচরণে আনা সত্য। বস্তুর স্বরূপের বিপরীত জানা, মানা, বলা বা আচরণে আনা অসত্য। তবে হিতের নামে সত্যের জায়গায় অসত্যের আচরণ করা সত্য নয়। ইতিহাস সাক্ষী, যারা সত্য কথা বলে তারা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হয়। আর যারা অসত্যের পথে চলে, তারা অপযশের পাত্র হয়। আজ মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে, কারণ অসত্য কথার ফলে বিশ্বাসের জায়গায় কপটতা দেখা যায়। একে অপরের প্রতি ঘৃণার কারণও এই অসত্য কথা। সত্য কথা বললে মানুষ শুধু নির্ভীক, শক্তিশালী এবং দৃঢ়ই হয় না, সকলের সম্মানের পাত্রও হয়। অসত্য কথা বলে কেউ ক্ষণিক সাফল্য বা তাৎক্ষণিক সুখ পেতে পারে, কিন্তু কালক্রমে ভয়, আশঙ্কা এবং রোগ তাকে শিকার করে নেয়, যার ফলে তার ধ্বংস হয়। তাই অসত্যরূপী এই রাবণের ধ্বংস সত্য দিয়ে করা যায়।
৩. অস্তেয়
মন, বাক্য এবং শরীর দিয়ে চুরি ত্যাগ করে উত্তম কাজে তন, মন, ধন দিয়ে সাহায্য করা অস্তেয়। আজ দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভ্রষ্টাচার। বড় বড় নেতা থেকে অফিসের ছোট কর্মচারী পর্যন্ত, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই ধীরে ধীরে এই পাপে আক্রান্ত হয়েছে। এটিও এক প্রকার চুরি। অন্যের ধন, সম্পত্তির প্রতি লোভ করার ফলে আমাদের অভ্যন্তরীণ শান্তি নষ্ট হয়। মানুষের জীবন অসংখ্য যোনিতে জন্মের পর লাভ করা যায়। এই অমূল্য জীবনকে আমরা এত অশান্তিতে কাটিয়ে দিই, কারণ আমরা সবসময় অন্যের ধনের প্রতি লোভ করি, চেষ্টা করি বা চুরি করি। এমন ব্যক্তিকে অজ্ঞানী না বলে কী বলবেন? তাই মন, বাক্য এবং শরীর দিয়ে চুরি ত্যাগ করে আমরা এই রাবণের ধ্বংস করতে পারি।
৪. ব্রহ্মচর্য
বেদ পড়া, ঈশ্বরের উপাসনা করা এবং বীর্য রক্ষা করা ব্রহ্মচর্য বলে। যখন যোগী মন, বাক্য এবং শরীর দিয়ে ব্রহ্মচর্যের দৃঢ় পালন করে, তখন বৌদ্ধিক এবং শারীরিক শক্তি লাভ হয়। এর ফলে সে নিজের এবং অন্যদের রক্ষা করতে, বিদ্যা অর্জন এবং বিদ্যা দানে সমর্থ হয়। ব্রহ্মচর্য পালনের ফলে শারীরিক ও বৌদ্ধিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। শরীরের শক্তি বাড়লে শরীর নীরোগ ও দীর্ঘায়ু হয় এবং উত্তম স্বাস্থ্য লাভ করে। বৌদ্ধিক শক্তি বাড়লে সে অতি সূক্ষ্ম বিষয় জানতে এবং অন্যদের বিদ্যা শেখাতে সফল হয়।
অথর্ববেদ ১১/৫/১৯-এ বলা হয়েছে, ব্রহ্মচর্যের তপস্যার মাধ্যমে দেবতারা মৃত্যুকে জয় করেন। মহাভারতে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন—হে রাজন! ব্রহ্মচর্যের গুণ শোন। যে মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করে, তার কোনো শুভ-অশুভ বাকি থাকে না। এমন জান যে, যার প্রতাপে অসংখ্য ঋষি ব্রহ্মলোকে, অর্থাৎ পরমানন্দস্বরূপ পরমাত্মায় বাস করেন এবং এই লোকেও অনেক সুখ লাভ করেন। যারা সত্যে রমণ করে, জিতেন্দ্রিয়, শান্ত আত্মা, উৎকৃষ্ট, শুভ গুণযুক্ত এবং রোগমুক্ত পরাক্রমী শরীরে ব্রহ্মচর্য, অর্থাৎ বেদাদি সত্য শাস্ত্র এবং পরমাত্মার উপাসনার অভ্যাস করে, তারা সব মন্দ কাজ ও দুঃখ নষ্ট করে সর্বোত্তম ধর্মযুক্ত কাজ এবং সকল সুখ লাভ করে। এই সেবনের মাধ্যমে মানুষ উত্তম শিক্ষক এবং উত্তম বিদ্যার্থী হতে পারে।
– অথর্ববেদ ও মহাভারত
ব্রহ্মচর্যের বিপরীত কাজকে ব্যভিচার বলা হয়। আজ সমাজে এই রাবণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে অনৈতিকতা ছড়াচ্ছে। এর দুষ্কর পরিণাম সকলের জানা। ভোগবাদের ব্যভিচার রূপী ঢেউয়ে ভেসে যুবক-যুবতীরা তাদের জীবন নষ্ট করে ফেলছে। কাঁচা বয়সে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত পাপ করে ফেলছে, যার ফলে পুরো জীবন অন্ধকারময় হয়ে যায়। এই অপরাধে মিডিয়া সবচেয়ে বড় দায়ী, কারণ অপরিপক্ক মানসিক অবস্থায় সঠিক-ভুলের সনাক্তকরণ খুব কম মানুষেরই থাকে। এই ব্যভিচার রূপী রাবণের কারণে কত জনের জীবন নষ্ট হচ্ছে আর হবে। তাই ব্রহ্মচর্য রূপী উত্তম নিয়ম পালনের মাধ্যমে এই রাবণের ধ্বংস করা যায়।
৫. অপরিগ্রহ
বিষয়ে উপার্জন, রক্ষণ, ক্ষয়, সংগ্রহ, হিংসার দোষ দেখে বিষয়ভোগের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সংগ্রহ না করা অপরিগ্রহ। অর্থাৎ ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় বস্তু এবং অহংকার ইত্যাদি ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় অশুভ চিন্তা ত্যাগ করা অপরিগ্রহ। যে যে বস্তু বা চিন্তা ঈশ্বর প্রাপ্তিতে বাধা দেয়, তাদের ত্যাগ করা এবং যে যে বস্তু বা চিন্তা ঈশ্বর প্রাপ্তির সাধন করে, তাদের গ্রহণ করা অপরিগ্রহ। আজকের সমাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু সংগ্রহের প্রতিযোগিতা চলছে। প্রত্যেকে জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে একটি মেশিনের মতো সংগ্রহের পিছনে ছুটছে, যার ফলে মানুষ মানসিক চাপ, দুঃখ, ভয় ইত্যাদির শিকার হয়ে জীবনকে নরক বানিয়ে ফেলছে। ভোগবাদের ঢেউয়ে ভেসে আমরা জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে গেছি। আমাদের চারপাশে এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়—কেউ কালোবাজারি করে সুখ পাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কী সুখ পাবে? কেউ প্রতারণা করে অন্যের সম্পত্তি দখল করে, কিন্তু কী সুখ পাবে? একেবারেই না। কেউ দিনরাত এক করে ধন সংগ্রহে ব্যস্ত, কিন্তু জানে না যে একটি সীমার পর এই ধন কেবলই বোঝা। আমাদের দেশের নেতা ও বড় ব্যবসায়ীরা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। এত ধন-সম্পত্তি সংগ্রহ করেও কেলেঙ্কারির পর কেলেঙ্কারি করা হচ্ছে। শেষে সব কিছু ছেড়ে মৃত্যুকে প্রাপ্ত হতে হবে। যদি সমাজ অপরিগ্রহের বাণী বুঝে নেয়, তবে সবাই সুখী হতে পারে। অপরিগ্রহের এই বাণী যদি জনমানস বুঝে নেয়, তবে ভ্রান্ত সমাজ অজ্ঞানতারূপী রাবণ থেকে মুক্তি পাবে।
৬. শৌচ
শৌচের একটি অর্থ শুদ্ধি। শুদ্ধি দুই প্রকার—বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ। জল ইত্যাদি দিয়ে, পবিত্র ভোজনের মাধ্যমে শরীরের বাহ্যিক শুদ্ধি হয়, আর মনের মলিনতা দূর করে শরীরের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি হয়। মানুষ তার শরীরের বাহ্যিক শুদ্ধির দিকে সব ধরনের মনোযোগ দেয়, যাতে সে সুন্দর দেখায়। এই সৌন্দর্যের কারণে সে ভ্রমে পড়ে শরীরের উপর অহংকার করে এবং অন্যের শরীরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। এই অহংকারের ফলে মানুষ সত্য থেকে দূরে চলে যায় এবং শরীরকে সুন্দর করতে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে। সৎসঙ্গ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর উপাসনা, আত্মনিরীক্ষণের জন্য তার কাছে সময় থাকে না। অভ্যন্তরীণ মলিনতার শুদ্ধি এই কাজগুলোর মাধ্যমে হয়। কিছু মানুষ অন্যের শরীরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়ে, যার ফলে কামবাসনার উদ্ভব হয়। অহংকার এবং কামবাসনা উভয়ই মানুষকে অভ্যন্তরীণভাবে অশুদ্ধ করে। অভ্যন্তরীণ শুদ্ধির ফলে বুদ্ধির শুদ্ধি হয়, যার ফলে মনে প্রসন্নতা ও একাগ্রতা আসে, ইন্দ্রিয়ের উপর জয়লাভ হয়, এবং বুদ্ধি ঈশ্বরের উপাসনায় লীন হয়, যার ফলে ঈশ্বরীয় সুখ লাভ হয়। আজকের সমাজে মাংসাহারের কারণে ভোজনের অপবিত্রতা হয়, যার ফলে শুধু শরীরই অশুদ্ধ হয় না, চিন্তাধারাও মলিন হয়। অহংকার এবং কামবাসনার কারণে মানুষের যত ক্ষতি হয়েছে, তার কল্পনাও করা যায় না। সমাজে ছড়িয়ে পড়া অরাজকতা থেকে মশাহার, অহংকার, কামবাসনারূপী রাবণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় যদি শৌচের (শুদ্ধির) পথে চলা যায়।
৭. সন্তোষ
সম্পূর্ণ প্রচেষ্টার পর যা কিছু লাভ হয়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা এবং তার বেশি কিছুর আকাঙ্ক্ষা না করা সন্তোষ। যে ব্যক্তি তার পূর্ণ প্রচেষ্টার পর উপলব্ধ সাধনের বেশি কিছুর আকাঙ্ক্ষা না করে, সে অতুলনীয় সুখ লাভ করে। যখন মানুষ ইন্দ্রিয়ভোগে আসক্ত থাকে, তখন তার বিষয়ভোগের তৃষ্ণা বাড়তে থাকে এবং সে সেই তৃষ্ণা পূরণের জন্য প্রচেষ্টা করে। ফল লাভের জন্য হয় সে অপরাধ করে বসে, নয়তো ব্যর্থ হয়ে দুঃখের ভাগী হয়। তাই সন্তোষ পালন করা উচিত, যার ফলে সাত্ত্বিক সুখ লাভ হয়, ক্ষণিক সুখ নয়। সন্তোষ পালনের ফলে আচরণেও সুখ লাভ হয় এবং দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যখন কোনো ক্ষতিকর ঘটনা ঘটে, তখন সন্তোষী ব্যক্তির কম দুঃখ হয়। তাই সন্তোষ জীবনে সুখ লাভের একটি কার্যকর পথ। আজ সমাজে সবাই দুঃখী, তার একটি কারণ সন্তোষের অভাব। তাই অসন্তোষরূপী রাবণকে ত্যাগ করে সন্তোষ পালনের মাধ্যমে অতুলনীয় সুখ লাভ করা যায়।
৮. তপ
ধর্মাচরণ করার সময় সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, মান-অপমান, শীত-গ্রীষ্ম, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ইত্যাদি শান্তচিত্তে সহ্য করা তপ। যে যে উত্তম কাজে নিজের এবং অন্যের দুঃখ দূর হয় এবং সুখ লাভ হয়, সেগুলো করে যাওয়া এবং না ছাড়া ধর্মাচরণ। ধর্মাচরণে যে যে দুঃখ সহ্য করতে হয়, তাকে তপ বলা হয়। আজ সমাজে অরাজকতার একটি কারণ হলো সজ্জন ব্যক্তিদের তপ না করা এবং দুষ্ট ব্যক্তিদের দুষ্কর্মকে না রোধ করা। শ্রী রাম সত্যযুগের একটি বিশেষ উদাহরণ, যিনি তাঁর তপস্যার মাধ্যমে রাক্ষস রাবণকে ধ্বংস করেছিলেন। তাঁর থেকে প্রেরণা নিয়ে আমাদেরও সমাজে ছড়িয়ে পড়া মন্দতা দূর করতে তপ করা উচিত, যার ফলে অধর্মরূপী রাবণের ধ্বংস করা যায়।
৯. স্বাধ্যায়
বেদাদি ধর্মশাস্ত্র পড়ে ঈশ্বরের স্বরূপ জানা, ঈশ্বরের চিন্তন-মনন করা, নিত্যকর্মের মানসিক পর্যালোচনা করে নিজের ভুলগুলো চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতে সেগুলো না করার প্রতিজ্ঞা করা স্বাধ্যায়। ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন এবং তা পালনের ফলে ব্যক্তির আচরণে এত যোগ্যতা আসে যে সে অন্যদেরও ধর্মের পথে চালাতে পারে। সমাজে সবসময় শ্রেষ্ঠ মানুষের কীর্তি হয়েছে। প্রথমে ব্যক্তির নিজের স্বাধ্যায় করা উচিত যে তার মধ্যে কী কী মন্দতা রয়েছে। তারপর সেগুলোর উপর জয়লাভ করা উচিত। এই কাজে ঈশ্বরই একমাত্র সহায় এবং তাঁকে জানার জন্য বেদাদি ধর্মশাস্ত্রের স্বাধ্যায় করা উচিত। আজ সমাজে প্রত্যেকে নিজেকে সবচেয়ে সঠিক এবং অন্যকে ভুল মনে করে। এর কারণ নিজেকে না জানা। যদি ব্যক্তি তার প্রকৃত সত্তাকে বোঝে এবং ধর্মগ্রন্থের স্বাধ্যায় করে সেই অনুযায়ী আচরণ করে, তবে সে কাউকে কষ্ট দেবে না। এমন ব্যক্তি শুধু বুদ্ধিমানই বলা হবে না, সমাজের পথপ্রদর্শকও হবে। স্বাধ্যায়শীল জ্ঞানী ব্যক্তিই সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারে। আজ সমাজের নেতৃত্ব অজ্ঞ ভোগী ব্যক্তিরা করছে, যার ফলে সমাজ গহ্বরে চলে যাচ্ছে। নিজেকে স্বাধ্যায়শীল এবং ঈশ্বরপ্রেমী করে সমাজের নেতৃত্ব যোগ্য ব্যক্তির হাতে হলে সমাজে অজ্ঞানরূপী রাবণের ধ্বংস হবে।
১০. ঈশ্বর প্রণিধান
সমস্ত বিদ্যার দাতা পরমগুরু ঈশ্বরের প্রতি সমস্ত কর্ম সমর্পণ করা, তাঁর ভক্তি করা, আচরণে তাঁর আদেশ পালন করা, শরীর ইত্যাদি বস্তুকে তাঁর বলে মনে করে ধর্মাচরণ করা, কর্মের লৌকিক ফল না চাওয়া, ঈশ্বরকে লক্ষ্য করে কর্ম করা ঈশ্বর প্রণিধান। মানুষ তখনই ভুল কাজ করে, যখন সে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। যদি মানুষ কোনো কাজ করার আগে ঈশ্বরের অনুকূল বা প্রতিকূল কিনা তা পরীক্ষা করে, তবে সে পাপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে। সমাজে পাপকর্ম রোধ করার এটি সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এর ফলে শুধু পাপাচরণ কমবে না, সাত্ত্বিক পরিবেশও তৈরি হবে। পাপরূপী রাবণের ধ্বংস করার এটি সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
আশা করি, যম-নিয়মের অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ, শৌচ, সন্তোষ, তপ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর প্রণিধান রূপী তলোয়ার দিয়ে হিংসা, অসত্য, চুরি, ব্যভিচার, ভ্রষ্টাচার, অশুদ্ধি, অসন্তোষ, অকর্মণ্যতা, অজ্ঞান এবং পাপাচরণরূপী রাবণের দশ মাথার ধ্বংস হবে। যোগীরা এই সিঁড়িতে চড়ে জীবনকে শ্রেষ্ঠ করেন এবং অভ্যন্তরীণ রাবণের ধ্বংস করেন। আশা করি, জিজ্ঞাসুরাও যোগমার্গ অনুসরণ করে তাদের জীবনকে সার্থক করবেন।